আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়...”
সে না হয় এলাম। মানুষ কিংবা শঙ্খচিল, যে বেশেই আসি না কেন। প্রশ্ন হল, রাস্তা চিনতে পারা যাবে কি । সত্যি বলতে, চিনতে না পারার কথা নয়, অন্তত বিজ্ঞান তা-ই বলছে তবে আমাদের মাথার ভিতর, মানে মস্তিষ্কে রয়েছে এক জিপিএস ট্র্যাক যা বহু দিন পরেও আমাদের ঠিক পথ চিনিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারে গ্রামের পৈতৃক ভিটায় কিংবা শহরে অলিগলি-পাকস্থলীর মধ্যে আজও টিকে থাকা বাল্যবন্ধুর বাড়িতে।
আজকাল স্মার্টফোন-ইন্টারনেট যুগে জিপিএস কথাটি আমাদের সকলেরই পরিচিত। জিপিএস গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম হল মূল একটি উপগ্রহ-নির্ভর নেভিগেশন সিস্টেম, যা আমাদের চলার পথের নিত্যসঙ্গী। ওলা-উবরের মতাে অ্যাপক্যাব থেকে শুরু করে নৌ এক বিমান-পরিবহণে জিপিএস-এর বহু ব্যবহার আমাদের কারও অজানা ন অথচ, মানব-মস্তিষ্কেই যে রয়েছে। জলজ্যান্ত এক জিপিএস, তা অজান ছিল বহু দিন। একটা ছােট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। জীবিকার প্রয়ােজনে রােজ যাঁদের কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়, তাঁরা কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে যান গুগত ম্যাপের কোনও রকম সাহায্য ছাড়া আর ঠিক সেখানেই কাজ করে আমাদের মস্তিষ্কের এই অভ্যন্তরীণ জিপিএস ব্যবস্থা, যা মূলত স্মৃতিনির্ভর। বলা বাহুল্য, এই জিপিএস তাদের শুধুমাত্র গন্তব্যে পৌঁছতে এবং তার যাত্রাপথ নির্ধারণের সাহায্য করে না,বরং কিছু ক্ষেত্রেই যাত্রাপথে প্রকৃতি, যেমন তার উচ্চতা বাকোঅর্ডিনেটস অনুযায়ী আমাদের কিছু তাৎক্ষণিক কার্যকলাপের সিদ্ধান্তকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ধরা যাক, সিঁড়ি দিয়ে ওঠা বা নামার সিদ্ধান্ত, কিংবা চলার পথে কোনও গর্ত দেখলে সেটিকে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত। মানবমন্তিকর এই জিপিএস ব্যবস্থা এবং তার কার্যদ্ধতিকেই আরও পরিষ্কার তবে আমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল)-এর নিক রবিনসন, নরওয়ের ক্যাভিল ইনস্টিটিউটের সুইস ডেসাম্পস, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্য ইনস্টিটিউটের জর্জ অ্যান্টন এবং ফ্রান্সের পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বজ্ঞানী মাইকেল হসার! তবে এই গবেষণার মূল ভিত্তি কিন্তু ইউসিএলএরই অন্য এক নােবেলজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর জন ওকিকি-র কাজ। ওকিকি প্লেস সেল আবিষ্কারের জন্য সালে নােবেল পুরস্কার পান।
২০১৪ কী এই প্লেস সেল? এই বিশেষ কোষ হল মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাল অঞ্চলে অবস্থিত এক ধরনের পিরামিড-আকৃতির স্নায়ুকোষ, যা আমরা কোনও একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করলে উদ্দীপিত হয়। স্থান এবং পরিবেশ অনুযায়ী এই উদ্দীপনার মাত্রা আবার বিভিন্ন। অর্থাৎ, এইউদ্দীপনার মাত্রা আপেক্ষিক এবং তা নির্ভর করে কোনও একটি বিশেষ স্থান। বা পরিবেশ মস্তিষ্কে ঠিক কোন ধরনের প্রভাব ফেলে, তার উপর। যে কোনও স্থানের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সেই স্থান-সংক্রান্ত কিছু স্মৃতির ক্রমপর্যায়। আর আমাদের হিপ্পোক্যাম্পাল অঞ্চলে অবস্থিত প্লেস সেলগুলি স্মৃতির এই ক্রমপর্যায়গুলিকেই গচ্ছিত রাখেনেভিগেশনের-এর মাধ্যমে, যা আধুনিক জিপিএস ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয়।
এই প্লেস সেল-এর সক্রিয়তা কী ভাবে আমাদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ জিপিএস ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে কোনও জায়গা এবং যাত্রাপথ চিনতে সাহায্য করে, সেটাই মস্তিষ্কের জিপিএস সংক্রান্ত গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
মানব-মস্তিষ্কের অধিকাংশ কার্যপদ্ধতিই সম্পন্ন হয় ইলেকট্রিক পােটেনশিয়ালের তারতম্যের কারণে। সেই তারতম্য দেখেই বােঝার চেষ্টা করা হয় যে, কোনও একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছলে ইদুরের মস্তিষ্কের কোন কোন প্লেস সেলগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমরা কোনও জায়গায় গেলে, সেখানকার পরিবেশ এবং সেখানে পৌঁছনাের যাত্রাপথের একটা মানচিত্র তৈরি হয়ে যায় আমাদের মস্তিষ্কে, প্লেস সেলগুলির সক্রিয়তার কারণেই। আর এই সক্রিয় কোষগুলিই পরবর্তী সময়ে আমাদের সেই গন্তব্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আর তা দেখাতেই বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রিত ভাবে লেসার-রশ্মি ব্যবহার করে ইদুরের মস্তিষ্কের কিছু নির্ধারিত প্লেস সেলকে উদ্দীপিত করে লক্ষ করেন যে, ইদুরগুলাে কোনও একটি পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যের পথে যাচ্ছে কি না। কোনও একটি গন্তব্যস্থলের স্মৃতি এবং যাত্রাপথের মানচিত্র মস্তিষ্কে তৈরি করে রাখে এক দল প্লেস সেল। এই কোষগুলি শুধুমাত্র ওই গন্তব্যস্থলের মানচিত্র তৈরিতেই কাজ করে।
গন্তব্যস্থল বিশেষে সক্রিয় হয়ে ওঠা এই প্লেস সেল-এর কারণেই আমরা কোনও স্থানে দু’-এক বার যাওয়ার পর, পরবর্তী কালে গুগল ম্যাপের কোনও রকম সাহায্য ছাড়াই পৌঁছে যেতে পারি। শুধুমাত্র আমাদের মস্তিষ্কের জিপিএস ব্যবস্থাকে সম্বল করেই ঘরে ফেরার পথ চিনতে আমাদের ভুল হয় না কোনও দিনও।